- 12 September, 2023
- 0 Comment(s)
- 476 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আলোকচিত্রী, তাও আবার কি না মহিলা, এবং বাঙালী! সময় বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে সবে শেষ হয়েছে। তখনও ভগৎ সিং ধরা পড়েননি। গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হতে তখনও বাকি আছে বেশ কিছু বছর। সেই বিশ শতকের বিশের দশকেই ‘পর্দা’ সরিয়ে আলোকচিত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন অন্নপূর্ণা। কেবল বাংলাতেই নয়, সারা দেশেই পেশাদার মহিলা আলোকচিত্রী হিসেবে সেই বোধহয় প্রথম কারও আত্মপ্রকাশ।
১৮৯৪ সালে অন্নপূর্ণার জন্ম। ১২ বছর বয়সে বিবাহ। স্বামী উপেন্দ্রনাথ দত্ত পেশাগত ভাবে ছিলেন আইনজীবী ও শখের আলোকচিত্রী। স্বামীর কাছ থেকেই অন্নপূর্ণার ক্যামেরার নেশা পেয়ে বসে। সেই থেকেই ছবি তুলতে শেখা। ছবি আঁকাতেও কিছুদিন হাত মকশো করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি ক্যামেরার নেশাটুকুই ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল। শিখলেন ছবি কিভাবে ডেভেলপ করতে হয়। অবশেষে ২৫ বছর বয়সে নিজেই নেমে পড়লেন পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে। রীতিমতো রোজগার করে সংসারে সেই টাকা দিতেন। সমাজে তখন তাঁর নামই হয়ে দাঁড়াল ‘ফটোগ্রাফার মাসিমা’। অবশ্য নিজের স্টুডিও বা দোকান জাতীয় কিছু ছিল না। উচ্চকোটির মানুষ যাঁরা, তাঁদেরই বাড়িতে গিয়ে, সেই উচ্চকোটির মানুষদের পর্দানসীন অর্ধাঙ্গিনী অথবা অন্তঃপুরবাসিনী অন্যান্য মহিলাদের ছবি তুলতেন। নিজে ‘পর্দা’র আড়াল ছাড়লেও, মূলত ‘পর্দা’র অন্তরালে থাকা মানুষদেরই ইতিকথা ফ্রেমে বন্দী করতেন অন্নপূর্ণা দত্ত, বাংলা তথা ভারতের অন্যতম প্রথম পেশাদার মহিলা আলোকচিত্রী।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, বহুদিন অবধি আলোকচিত্রীর পেশায় একচ্ছত্র পুরুষদেরই আধিপত্য ছিল। ব্যতিক্রম যে ছিল না তাও নয়। ১৮৪০এর দশকে ব্রিটিশ বোটানিস্ট আনা এ্যাটকিনসের নাম পাচ্ছি। সায়ানোটাইপ পদ্ধতির সাহায্যে তিনি কাগজের উপর ফুল-লতা-পাতার ছবি ছাপতে চেষ্টা করতেন। ১৮৬০ সাল নাগাদ লন্ডন শহরে দুএকজন মহিলা আলোকচিত্রীর বিষয়ে শোনা যায়। ভারতে প্রথম সেকেন্দ্রাবাদ শহরে, লালা দীনদয়াল নামে একজন তাঁর ফটোগ্রাফি স্টুডিওতে ‘জেনানা’ বিভাগ চালু করেন। জনৈকা কেনি-লেভিক সেই স্টুডিওতে মহিলাদের ছবি তোলার দায়িত্বে ছিলেন।
গবেষক সিদ্ধার্থ ঘোষের বক্তব্য অনুসারে, ১৮৯৯ সালে কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকায় ‘মহিলা আর্ট স্টুডিও এ্যাণ্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর’এর বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে “সম্পূর্ণ আড়ালে ও সম্মানজনক ব্যবস্থায় শ্রীমতি সরোজিনী ঘোষের তত্ত্বাবধানে মহিলাদের ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে।” সেই থেকেই বোধহয় কাচের দেওয়াল ভাঙার সূচনা। এও জানা যাচ্ছে ভারতের প্রথম আইসিএস অফিসার তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, তিনিও নাকি ঐতিহাসিক বোর্ন এ্যাণ্ড শেফার্ড স্টুডিওতে গিয়ে হাতেকলমে ক্যামেরা ব্যবহার করতে শিখেছিলেন। যদিও পেশাগত ভাবে তিনি সেই শিক্ষাকে কোনও দিন কাজে লাগাননি। যুগ পালটানোর সাথে সাথে ক্রমশ কলকাতার অভিজাত মহলে ক্যামেরায় ছবি তোলার চল মহিলা-মহলেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে সেই সংখ্যা কখনই উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়েনি। ১৯২০-৩০এর দশকে পাশ্চাত্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাতে মহিলারা এই পেশায় আসতে শুরু করলেও, সরোজিনী ঘোষের পর সেভাবে কোনও নাম বাংলা তথা ভারতে উঠে আসতে পারেনি। ১৯৩০এর দশকে মীরা মৈত্র ও ইন্দিরা মৈত্র, এবং দেবলীনা সেন ও মনোবীণা সেন, এই দুই দুই চার বোনের জুটির কথা শোনা যায়, যাঁরা অপেশাদার ভাবে ফটোগ্রাফি চর্চা করেছিলেন। এর মধ্যে দেবলীনা-মনোবীণা জুটির ছবি ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইণ্ডিয়া’র মতো প্রসিদ্ধ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়।
অন্নপূর্ণা দত্তই প্রথম, যিনি পেশাদার ভাবে মানুষের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের প্রয়োজন মাফিক ছবি তুলতেন, এবং নিজে সেই ছবি ডেভেলপ করে আবারও ক্রেতার হাতে পৌঁছিয়ে দিতেন। সেই সময়ের অভিজাত সম্প্রদায়ের মহিলারা অনেকেই অন্নপূর্ণার ক্যামেরায় ফ্রেম-বন্দী হয়েছিলেন। অন্নপূর্ণা দেবীর নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গায়ক আব্বাসউদ্দিন, কবি জসীমউদ্দিন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য হাসান সুহরাবর্দির পরিবার। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, বাংলার অন্যতম কুখ্যাত রাজনৈতিক চরিত্র হোসেন সুহরাবর্দির সঙ্গে কেউ যেন হাসান সুহরাবর্দিকে গুলিয়ে না ফেলেন। হাসান সাহেব কেবল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্যই ছিলেন না, তিনি উপমহাদেশের দ্বিতীয় মুসলমান নাগরিক হিসেবে ইংল্যাণ্ডের স্বনামধন্য রয়্যাল কলেজ অব সার্জনের ফেলোও নির্বাচিত হন। এই সুহরাবর্দি পরিবারেই আলোকচিত্রী হিসেবে অন্নপূর্ণার যাতায়াত ছিল। এঁদেরই বাড়িতে ১৯৩৭ সালে অন্নপূর্ণা সেই ঐতিহাসিক ছবিটিকে ফ্রেমবন্দী করেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি বসে আছেন অরুণা আসফ আলি (’৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় যিনি অসমসাহসের সঙ্গে বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক উদ্যানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন), নেলি সেনগুপ্ত (কলকাতা পুরসভার প্রথম মহিলা অল্ডার(উও)ম্যান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন) ও সরোজিনী নাইডুর (কবি ও কংগ্রেস সভাপতি, স্বাধীনতা আন্দোলনে যিনি অন্যতম ভূমিকা নেন) মতো ব্যক্তিত্বেরা; আর সবার পিছনে নিজস্ব প্রতিভার স্ফূরণে ফ্রেম আলোকিত করে দাঁড়িয়ে স্বয়ং সুভাষচন্দ্র!
জানিনা অন্নপূর্ণা কখনও ব্যক্তিগত মহলে আক্ষেপ করেছিলেন কি না, উচ্চকোটির সেই সমস্ত মানুষদের বাড়িতে তিনি যখন পর্দার আড়ালে থাকা মানুষদের ছবি তুলতেন, অনেক ক্ষেত্রেই ছবি তোলার সময়েও ছবির চরিত্রেরা পর্দার আড়ালেই থেকে যেতেন, অথবা থাকতে বাধ্য হতেন। কারণ ছবি ছাপা হয়ে এলেও তো, সেই ছবি পরপুরুষদের হাতে পড়তে পারে। কাজেই, ছবিতেও থাক পর্দারই আবরণ … এমন ছবি তোলার দরকারটুকুই হয়তো অদ্ভুৎ মনে হত অন্নপূর্ণার। মুসলিম সমাজে এই পর্দার প্রয়োগ ছিল অনেক বেশি। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সেই প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
১৯৭৬ সালে, ৮২ বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন ‘ফটোগ্রাফার মাসিমা’ অন্নপূর্ণা দত্ত। আগাগোড়া পুরুষশাসিত সমাজে, এমন একটি পেশায় যিনি স্রেফ ভালোবাসা এবং পরিশ্রমটুকু দিয়ে নীরব পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি তিনি নিজেরও একটি ‘সেলফ পোর্ট্রেট’ তোলেন, নিজস্বী-যুগের অনেক আগেও নিজস্ব প্রতিভার বিচ্ছূরণে অনন্যা হয়ে উঠেছিলেন অন্নপূর্ণা। তাঁর বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
সূত্রঃ
[১] https://en.wikipedia.org/wiki/Annapurna_Dutta
হাসান সুহরাবর্দির বাড়িতে অরুণা আসফ আলি, নেলি সেনগুপ্ত, সরোজিনী নাইডু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখের প্রতিকৃতি, ছবিটি তুলেছেন অন্নপূর্ণা দত্ত, ১৯৩৭
তথ্যসূত্র, চিত্রঋণঃ ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment